January 3, 2025, 7:38 pm

সংবাদ শিরোনাম :
স্বৈরাচারের শেষ সময়ে রাজউকের জমি অবৈধ বরাদ্দ : প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশ মেঘদাইর গ্রামে শাজাহান আর মাইনুদ্দিন মাইন্না ডাকাতের অত্যাচারে অত্যাচারিত মেঘদাইর গ্রাম বিপুল পরিমাণ আতশবাজি, পটকা ও বিস্ফোরক দ্রব্যসহ একজনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি-লালবাগ শুধু কি প্রশাসন ক্যাডারই আচরণবিধি লংঘন করছে?  খিলক্ষেত পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে লাশ গুম রহস্যময় হত্যা নাকি আত্মহত্যা?? কালীগঞ্জে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সম্মেলন ও কমিটি গঠন আনন্দ টেলিভিশনের সাংবাদিক মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরীকে (৩৭) অজ্ঞাত মোবাইল নম্বর থেকে হুমকি খিলক্ষেত প্রেসক্লাবের আংশিক   কমিটি ঘোষণা ২০২৪ দৌলতপুর এক রিক্সাচালকের মরদেহ উদ্ধার পোরশায় সাদিয়ানী কতৃক মানুষ হত্যার প্রতিবাদে গণপ্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত

শুধু কি প্রশাসন ক্যাডারই আচরণবিধি লংঘন করছে? 

বিশেষ প্রতিনিধিঃ জনপরিসরে সাম্প্রতিককালে যে বিষয়টি নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলছে, তা হলো জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিষয়ে বিভিন্ন ক্যাডারের দ্বন্দ্ব। মূলত প্রশাসন ক্যাডারের বিরুদ্ধে বাকি ২৫ ক্যাডারের এ আন্দোলনে পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিতর্কের পাশাপাশি এমন কিছু বিষয় নজরে এসেছে, যা সরকারি কর্মচারীদের কোড অফ কন্ডাক্ট এর মধ্যে পড়ে কিনা সে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, ১৭ ডিসেম্বর তারিখে সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবের ব্রিফিংয়ের পর থেকে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যগণ সরব হয়ে উঠেন। ব্রিফিংয়ে প্রশাসন ক্যাডারের লাইন পদ উপসচিব পদে অন্যান্য ক্যাডারের জন্যে ৫০% কোটার সুপারিশ করার পর সংক্ষুব্ধ প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে একত্রিত হয়ে কমিশনের সদস্য সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজেদের ভাবনার বিষয়টি অবহিত করেন। প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক এবং বর্তমান সদস্যবৃন্দ গত ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের ব্যানারে প্রতিবাদ সভা করেন। উল্লেখ্য যে, এটি ছিল সরকারি ছুটির দিন এবং জনসেবা বাধাগ্রস্ত হবার কোনো ব্যাপার ছিল না। এরপর থেকে প্রশাসন এমন কিছু করতে পারে কিনা সে বিষয়ে তর্ক বিতর্ক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, সরকারি কর্মচারীদের আচরণবিধি সকল সরকারি কর্মচারীর জন্যেই প্রযোজ্য। প্রশাসনের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই বাকি ২৫ ক্যাডার সহ অন্যান্য নন ক্যাডার সকল কর্মচারী আচরণবিধির অধীনে রয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনাটি নতুন নয় এবং প্রশাসন ক্যাডার এক্ষেত্রে প্রথম নয়। এ বিষয়ে কিছু ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে।

গত ৩ অক্টোবর সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনাব আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৮ সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। প্রশাসন বাদে বিসিএসের বাকি ২৫ ক্যাডারের জোট আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ ৫ অক্টোবর একটি সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। এ সংবাদ সম্মেলনের শিরোনাম ছিল জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যদের প্রত্যাখ্যান, কমিটিতে সকল ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব চাই। এ সংবাদ সম্মেলনে বিসিএস তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা জনাব মনির হোসেন বলেন, বৈষম্যপূর্ণ এ কমিশন কোনোভাবেই বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে না; বরং বিদ্যমান সিভিল প্রশাসন আরও গণবিরোধী হবে। তাই তাঁরা এই কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করছেন। শিক্ষা ক্যাডারের মফিজুর রহমান বলেন, আমরা সরকারের কাছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটি পুনর্গঠনের দাবি তুলে ধরেছি। আমরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। রাজপথে নামতে চাই না। সরকারকে বুঝতে হবে আমরা দেশের মোট ৯০ থেকে ৯২ ভাগ ক্যাডার কর্মকর্তার প্রতিনিধিত্ব করি। তাই আমাদের উপেক্ষা করা হলে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। এ সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জনগণের করের টাকায় বেতনভুক্ত ব্যক্তি কোনোভাবেই জনগণের প্রশাসক হতে পারেন না। তাই জনপ্রশাসন শব্দটি যথাযথ নয়। সময় এসেছে এসব চিন্তা করার। ভ্রান্তনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। কারণ, জনপ্রশাসন শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষকে শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের বীজ। এ সময় আধুনিক বাংলাদেশের সেবা ব্যবস্থাপনা থেকে জনপ্রশাসন শব্দটি বাতিলের দাবি জানানো হয়।

সরকার কর্তৃক বিধিবদ্ধভাবে গঠিত একটি সংস্কার কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করা, সংবাদ সম্মেলন করে যেকোনো পদক্ষেপের হুমকি দেওয়া, মীমাংসিত সরকারি পরিভাষাকে প্রকাশ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর লঙ্ঘন। বিধি ২৩(১) এ বলা হয়েছে সরকারি কর্মচারী জনসম্মুখে এমন কোনো বিবৃতি বা মতামত প্রকাশ করতে পারবেন না যা সরকারকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলতে পারে। এছাড়াও, ৩০এ বিধির (এ), (বি), (সি), (ডি) উপবিধিতে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে সরকারি কর্মচারীর আচরণ সম্পর্কে। সরকারি কর্মচারী সরকারের কোনো আদেশ বা সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জনসম্মুখে আপত্তি উপস্থাপন করতে পারবেন না, আন্দোলন করতে প্ররোচিত করতে পারবেন না , সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারবেন না, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি, বিদ্বেষ বা অসন্তুষ্টি তৈরি করতে পারে এমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবেন না।

স্পষ্টতই, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ এর ৫ অক্টোবর ২০২৪ এর সংবাদ সম্মেলনটি ছিল সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুযায়ী অসদাচরণ।

১৯ অক্টোবর ২০২৪ পুনরায় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের আয়োজনে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার খামারবাড়ির তুলা ভবনে অনুষ্ঠিত হয় এ সভা। সভায় কর্মকর্তারা আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস প্রদান করেন। সভায় ২৫ ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া একটি ক্যাডারের সদস্যদের দিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করায় তা প্রত্যাখ্যান করে সব ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে কমিশন পুনর্গঠনের আহ্বান জানানো হয়। সরকারকে বিভ্রান্ত করে পূর্বের ন্যায় একপেশে সুপারিশ সম্বলিত কমিশন রিপোর্টের বিষয়ে সতর্ক থাকতে সবাইকে অনুরোধ করা হয়।

১৯ অক্টোবর পুনরায় কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। যা ইতঃপূর্বে বর্ণিত আচরণ বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহের লঙ্ঘন। অর্থাৎ, সংস্কার কমিশন গঠনের পর থেকেই প্রশাসন বাদে অন্যান্য সকল ক্যাডারের নেতৃত্বে সরকারি কর্মচারীর আচরণবিধি প্রতিপালনে অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকার কর্তৃক গঠিত কমিশনকে সহযোগিতা না করে তাকে বারবার প্রত্যাখ্যান করা অসদাচরণ এবং বিভাগীয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

১৬ নভেম্বর ২০২৪ রাজশাহীতে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের বিভাগীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন গণপূর্ত ক্যাডারের অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুল গাফফার। বিশেষ অতিথি ছিলেন পোস্টাল ক্যাডারের কর্মকর্তা পোস্ট মাস্টার জেনারেল কাজী আসাদুল ইসলাম। এ সভায় পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় গঠন অর্থাৎ ‘ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’ এবং পক্ষপাতদুষ্ট জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন পুনর্গঠন করাসহ বেশ কিছু দাবি ও সুপারিশ করে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ।স্পষ্টতই, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে উক্ত কর্মকর্তারা সরকারি কর্মচারীর আচরণ বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ লঙ্ঘন করেছেন।

২৪ ডিসেম্বর ও ২৬ ডিসেম্বর উক্ত ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ যথাক্রমে এক ঘণ্টার কর্মবিরতি এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। উল্লেখ্য যে, দিন দুইটি ছিল মঙ্গলবার এবং বৃহস্পতিবার। উক্ত দুইদিন সরকার ঘোষিত কোনো ছুটি ছিল না। অর্থাৎ, দাপ্তরিক কর্মঘণ্টা নষ্ট করে, জনগণকে সেবা থেকে বঞ্চিত করে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে কলম বিরতি এবং মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। এ মানববন্ধনে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতি হুঁশিয়ারি এবং আন্দোলনের হুমকি প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য যে, উক্ত কার্যক্রম সরকারি কর্মচারীর আচরণবিধির গুরুতর লঙ্ঘন এবং গুরুদণ্ডের শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

উপরের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রশাসন ক্যাডারের প্রতিবাদ সভাটি আয়োজনের বহু আগে থেকেই বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মচারীগণ আচরণবিধির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছেন। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এ বিষয়ে প্রারম্ভেই সতর্ক করা প্রয়োজন থাকলেও সেটা করা হয়নি। বরং, কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করা, কমিশনের বিরুদ্ধে হুমকি দেয়ার বিষয়গুলোতে কর্তৃপক্ষের নীরবতার কারণে এমনটা মনে হতে পারে যে, কর্তৃপক্ষ কি ২৫ ক্যাডারের আন্দোলনের ভাষা সমর্থন করে কিনা। প্রশাসনের প্রতিবাদ সভা আচরণবিধির লঙ্ঘন হয়ে থাকলে এ আচরণবিধি সংস্কার কমিশন গঠনের শুরু থেকেই আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ লঙ্ঘন করে আসছে। একই যাত্রায় ভিন্ন ফল কাম্য নয়। আচরণবিধি সকল সরকারি কর্মচারীর প্রতি সমভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত এবং সরকারি কর্মচারী হিসেবে সরকারের নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রবণতাকে প্রারম্ভেই থামানো জরুরি। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ সংস্কার কমিশন গঠনের পর থেকে নীরবতা পালন করে আসছিলেন। কিন্তু ক্রমাগত তারা তাদের অন্যান্য ক্যাডারের সহকর্মীদের আচরণবিধির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন ও উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে নীরবতা ভঙ্গ করেন। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আসাটা অপ্রত্যাশিত না হলেও এ অভিযোগে সকলেই সমভাবে অভিযুক্ত হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সমতা বজায় রাখা রাষ্ট্রের স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায়, বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে এ অগ্রযাত্রায় বৈষম্যকেই প্রশ্রয় দেয়া হবে।

এই পোস্টটি আপনার সামাজিক মিডিয়াতে ভাগ করুন