October 24, 2024, 2:27 pm
মনির হোসেন জীবনঃ-– নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’র ঢাকা অঞ্চলের দাওয়াতী শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজবাহ ওরফে আবু মাসরুরসহ ৬ সদস্যকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এরা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত, ইউরোপে উচ্চশিক্ষা নেওয়া ২ জনসহ রয়েছেন চিকিৎসকও।
র্যাব জানিয়েছে, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের প্রায় ৩ হাজার এবং হলি আর্টিজান হামলার পরবর্তী সময়ে প্রায় ২ হাজার জঙ্গীকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে এলিট ফোর্সর্যাব।
আজ মঙ্গলবার র্যাব-১ এর সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার ও সিনিয়র সহকারি পরিচালক মো: পারভেজ রানা জানান, গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-১ ও ডিজিএফআই এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর উত্তরা, বনানী, বনশ্রী ও যাত্রাবাড়ি এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।
তিনি জানান, গ্রেফতারকৃতরা হলেন, জঙ্গী সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’র ঢাকা অঞ্চলের দাওয়াতী শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ওরফে আবু মাসরুর (৫০), পিতাঃ মৃত শওকত আলম চৌধুরী, কক্সবাজার, শেখ আশিকুর রহমান ওরফে আবু আফিফা (৪৯), পিতাঃ মৃত শেখ সফিকুল ইসলাম, ব্রাক্ষণবাড়ীয়া, সাদী মোঃ জূলকার নাইন (৩৫), পিতাঃ মৃত জাহিদ হোসেন, ঢাকা, মোঃ কামরুল হাসান সাব্বির (৪০), পিতাঃ মৃত নুরুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গা, মোঃ মাসুম রানা ওরফে মাসুম বিল্লাহ (২৬), পিতাঃ মনসুর আলী, ঠাকুরগাঁও ও সাঈদ মোঃ রিজভী (৩৫), পিতাঃ মোঃ জালাল উদ্দিন, চাঁদপুর। তারা উচ্চশিক্ষিত, ইউরোপে উচ্চশিক্ষা নেওয়া ২ জনসহ একজন চিকিৎসক রয়েছে। পারভেজ রানা জানান, এসময় গ্রেফতারকৃতদের নিকট থেকে ২টি ল্যাপটপ, ৬টি মোবাইল ফোন, উগ্রবাদে সহায়ক পুস্তিকা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম সংক্রান্ত ডায়রী ও নোট বই উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’র সক্রিয় সদস্য। এছাড়া তারা আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে উদ্বুদ্ধ হয়ে আল কায়েদা মতাদর্শের জঙ্গী সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’র আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তারা বিভিন্ন সময় অনলাইনে বিভিন্ন উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্য দেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে ওই সংগঠনে যোগদান করে। পরবর্তীতে তারা সংগঠনের সদস্য সংগ্রহে দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের উপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ভুল বুঝিয়ে সংগঠনের সদস্যদের তথাকথিত জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী করে তোলে। এ উদ্দেশ্যে সংগঠনের সদস্যদেরকে তারা বিভিন্ন উগ্রবাদি পুস্তিকা, মুসলমানদের উপর নির্যাতন ও উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সরবরাহ করতো।
র্যাব বলছে, এছাড়াও তারা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভুল তথ্য প্রদান করে তাদের আত্মীয়- স্বজন, বিভিন্ন মাদ্রাসা ও সদস্যদের নিকট থেকে নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করতো। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তারা মসজিদ, বাসা বা বিভিন্ন স্থানে সদস্যদের নিয়ে গোপন সভা পরিচালনা করতো বলে স্বীকার করেন। আটককৃতরা বিভিন্ন অপব্যাখা ও মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে দেশের বিচার ও শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিতৃষ্ণা তৈরি করে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য সদস্যদেরকে উগ্রবাদী করে তুলতো। এছাড়াও তারা পার্শবর্তী বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন উগ্রবাদী গ্রুপে বিচরণ ছিল বলে জানা যায়।
র্যাব জানিয়েছে, গ্রেফতারকৃত জঙ্গি নেতা মিজবাহ ওরফে আবু মাসরুর দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য ২০০৪ সালে ইউরোপীয় একটি দেশে গমন করেন এবং ফিন্যান্স এ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। ২০১০ সালে গ্রীনকার্ড স্কীমের মাধ্যমে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে সপরিবারেইউরোপীয় একটি দেশেস্থায়ী বসবাস শুরু করেন। ঢাকা অঞ্চলের দাওয়াতী শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি দেশে ও দেশের বাহির থেকে সংগঠনের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতো বলে জানা যায়। তিনি ঢাকা, ঠাকুরগাও, দিনাজপুর, লক্ষীপুর, ভোলা এবং খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক সফর, সভায় অংশগ্রহণ এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ ও চাঁদা আদায় করতেন বলে জানা যায়।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত জঙ্গি শেখ আশিকুর রহমান ওরফে আবু আফিফা একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএস সম্পন্ন করে। সে একটি বেসরকারী কোম্পানীতে চাকুরীর পাশাপাশি এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবসাও করতেন। আশিকুর স্বপরিবারে ইউরোপীয় একটি দেশে বসবাসকালীন মিজবাহের সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি সংগঠনটির ঢাকা অঞ্চলের অন্যতম উপদেষ্টা ও অর্থের যোগানদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলো।
গ্রেফতারকৃত সাদী মোঃ জূলকার নাইন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে গার্মেন্টস সেক্টরে চাকুরিরত ছিল। সে গ্রেফতারকৃত মিজবাহ এর মাধ্যমে ‘আনসার আল ইসলাম’ এর সাথে যুক্ত হয় এবং ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন দাওয়াতী কার্যক্রমের পাশাপাশি সংগঠনের নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতো। এছাড়াও সে মেজবাহ এর কাছ থেকে বিভিন্ন উগ্রবাদী পুস্তিকা, মুসলমানদের উপর নির্যাতন ও উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সংগ্রহ করতো।
এছাড়া গ্রেফতারকৃত মোঃ কামরুল হাসান সাব্বির একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে আইটিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে একটি আইটি ফার্মে কর্মরত ছিল। সে গ্রেফতারকৃত শেখ আশিকুর রহমান ওরফে আবু আফিফা এর মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে দাওয়াতী কার্যক্রম করছিল। তথ্য প্রযু্িক্ততে তার দক্ষতা থাকায় বিভিন্ন সময় সে ইন্টারনেট থেকে মুসলমানদের উপর নির্যাতনের ভিডিওসহ বিভিন্ন ধরণের উগ্রবাদী কনটেন্ট সংগ্রহ করে মেজবাহ কে সরবরাহ করতো।
র্যাব বলছে, অপরদিকে, গ্রেফতারকৃত সাঈদ মোঃ রিজভী পেশায় একজন চিকিৎসক। ২০২১ সালে একটি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে অবস্থানকালীন উগ্রবাদী মতাদর্শের উদ্বুদ্ধ হন। পরবর্তীতে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেজবাহর সাথে পরিচয় হয় এবং তার মাধ্যমে সংগঠনে যোগ দেয় এবং সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা প্রদান করতো। তার বাসায় প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর সংগঠনের সভা অনুষ্ঠিত হতো এবং নতুন সদস্যদের সংগঠনে যুক্ত করার আনুষ্ঠানিকতাও সেখানে সম্পন্ন হতো। এছাড়াও তার বাসায় সংগঠনের নতুন সদস্যদের শারীরিক কসরত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত মোঃ মাসুম রানা ওরফে মাসুম বিল্লাহ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। সে সাদী জূলকার নাইন এর মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়। সে তার নিজ এলাকায় দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতো এবং সে সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা প্রদান এবং সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করতো বলে স্বীকার করেছে।গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে বলে জানান র্যাবের এ কর্মকর্তা।